বিমানের ঝুঁকিপূর্ণ টেকঅফ

Biman_Bangladesh_Airlines_DC-10-30_S2-ACP_KUL_2007-4-7পাইলটদের অদক্ষতা, অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশ বিমানের ব্র্যান্ড নিউ এয়ার ক্রাফট মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে টেকঅফ করেছে। ফলে ভয়াবহ দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর-এর পৌনে চারশ’ যাত্রী। একই সঙ্গে রক্ষা পেয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকার সম্পদ নতুন এয়ার ক্রাফটটিও।
জানা গেছে, নিয়মানুযায়ী রানওয়ে শেষ হওয়ার তিন হাজার ফুট আগেই প্রতিটি ফ্লাইট টেকঅফ করে থাকে। ৩ মার্চ ঢাকা জেদ্দাগামী ০৩৫ ফ্লাইটটি নির্ধারিত সীমারেখা থেকে টেকঅফ করতে পারেনি। ওই দিন এয়ারক্রাফটের মোট ওজনের (এয়ারক্রাফট ও পণ্যসহ ওজন) সঙ্গে ইঞ্জিনের শক্তির সমন্বয় না করায় নির্ধারিত সীমারেখা থেকে টেকঅফ করার মতো গতি সঞ্চয় করতে পারেনি ফ্লাইটটি। এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশংকা তৈরি হয়। কিন্তু রানওয়ের শেষ প্রান্তে এসে ব্যারিয়ার (উড়োজাহাজ থামানোর জাল) ভেঙে অলৌকিকভাবে বিমানটি টেকঅফ করে। রক্ষা পায় সবকিছু।
ভয়াবহ এ ঘটনাটি বিমান কর্তৃপক্ষ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালায় বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। সিভিল এভিয়েশনের টাওয়ার পয়েন্ট থেকে তথ্য ফাঁস হলে তোলপাড় শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত বিমানের সিনিয়র পাইলট জামিল আহমদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি বিমানের ব্ল্যাক বক্স ও এফডিএম (ফ্লাইট ডাটা মনিটরিং) বক্স নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছে। এ বিষয়ে বিমানের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ।
বিমানের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) আসাদুজ্জামান বলেন, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। তদন্ত চলছে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বিমানের এফডিএম বক্স থেকে উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের সব তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, সেদিন এয়ারক্রাফটটির মোট ওজন ছিল ২৯৭.৯৪ টন। এই ওজনের একটি ফ্লাইট টেকঅফ করতে ইঞ্জিনের শক্তির প্রয়োজন ৯৭ শতাংশ। কিন্তু পাইলটরা ইঞ্জিনে পাওয়ার (শক্তি) দিয়েছিলেন ৮৭.৪ শতাংশ। যা প্রয়োজনীয় শক্তির চেয়ে ১১ শতাংশ কম ছিল। ফলে এয়ারক্রাফটি প্রয়োজনীয় শক্তি পায়নি। এতে টেকঅফ (আকাশে উড়া) করতে বেশি সময় নিয়েছিল। বিমানের বহরে থাকা বর্তমান বোয়িং ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। পাইলট ও ফার্স্ট অফিসাররা শুধু প্রয়োজনীয় ডাটা পুশ ও মনিটরিং করে থাকেন। সে অনুযায়ী ইঞ্জিন কাজ করে। এতে কোনো ধরনের ভুল হলেই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। সেদিনও ভুলের কারণেই বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা তৈরি হয়েছিল।
এভিয়েশন সেক্টরের বিশেষজ্ঞদের মতে, এর আগে গোটা বিশ্বে এ ধরনের ২টি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। দুটিতেই ক্রু ও যাত্রী কাউকে বাঁচানো যায়নি। চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে পুরো উড়োজাহাজ। সেদিন ব্যারিয়ারের সামনে এসে ফ্লাইটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেকঅফ না করলে পাইলট ও ক্রু কারও পক্ষেই ওই মুহূর্তে দুর্ঘটনা থেকে উড়োজাহাজটি রক্ষা করা সম্ভব ছিল না।
বিমান পরিচালনা পর্যদের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল আলম বলেন, রানওয়ে শেষ হওয়ার ৩ হাজার ফুট আগে উড়োজাহাজটি টেকঅফ না হওয়ার ঘটনাটি শুধু দুর্ঘটনাই নয়, এটি ভয়াবহ ও বড় ধরনের দুর্ঘটনা। তিনি শুনেছেন আর ১০ সেকেন্ড পার হলেই ওইদিন এয়ারক্রাফটটি ক্র্যাশ করত। তিনি বলেন, বিমানের প্রতিটি ফ্লাইটে লুকানো কার্গো থাকে। কাগজে-কলমে কখনোই কার্গোর হিসাব মেলে না। যতই লুকানো থাকুক পাইলটদের পক্ষে উড়োজাহাজ টেকঅফের আগে এটা বের করা সম্ভব। সে অনুযায়ী ইঞ্জিনের শক্তি সমন্বয় করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, অলৌকিক কিছু না হলে ওইদিন দুর্ঘটনা থেকে উড়োজাহাজ ও যাত্রীদের রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। এ ব্যাপারে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন, সিডিউলিং, পাইলট, বাপা ও সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে তিনি জানান।
বিমানের সিডিউলিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ওই ফ্লাইটে বিমানের দু’জন সিনিয়র পাইলটকে ডিউটি দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন চুক্তিভিত্তিক সিনিয়র পাইলট ক্যাপ্টেন বেলাল অপরজন সম্প্রতি বোয়িং ৭৭৭-এ ট্রেনিং শেষ করা পাইলট ক্যাপ্টেন রেজোয়ান। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য সেদিন ককপিটে ডান পাশে ফার্স্ট অফিসারের আসনে বসেছিলেন পাইলট ইন কমান্ড সিনিয়র পাইলট ক্যাপ্টেন বেলাল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পাইলট জানান, সেদিনের ওই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী সিডিউলিং বিভাগ। নিয়ম অনুযায়ী কোনো ফ্লাইটে একসঙ্গে দু’জন পাইলটকে ডিউটি দেয়া যায় না। তাতে ফ্লাইটের চেইন অব কমান্ড থাকে না। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ফ্লাইটে একজন পাইলট ও একজন ফার্স্ট অফিসার থাকবে। ককপিটের বামে বসবেন পাইলট অব কমান্ড আর ডান পাশে বসবেন ফার্স্ট অফিসার। আকাশে মূলত ফার্স্ট অফিসারই বিমান চালান। মনিটরিং করেন চিফ পাইলট। কিন্তু সেদিনের সিডিউলিংয়ে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। তার ধারণা, সেদিনের এ দুর্ঘটনার জন্য দুই পাইলটের সমন্বয়হীনতাও অনেকাংশে দায়ী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিডিউলিং বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন নাদিম জানান, ফার্স্ট অফিসার ছিল না বলে দুই পাইলটকে একসঙ্গে পাঠানো হয়েছিল। তিনি বলেন, দুই পাইলটকে একসঙ্গে ফ্লাইটে পাঠানো যাবে না এমন কোনো নিয়ম নেই।
অপরদিকে বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন (ডিএফও) ক্যাপ্টেন কামাল সাঈদ বলেন, বাংলাদেশ বিমানের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটেনি। তাই সবকিছু বুঝে উঠতে একটু সময় লাগছে। তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থা ইতিমধ্যে এয়ারক্রাফটের এফডিএম বক্স উদ্ধার করেছে। ওই এফডিএমে ওই সময় এয়ারক্রাফটে যা যা ঘটেছিল তার সব তথ্য আছে।
এদিকে বিমানের ইতিহাসে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা ঘটলেও এর সঙ্গে জড়িত কারও বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দুই পাইলট ক্যাপ্টেন বেলাল ও ক্যাপ্টেন রেজোয়ানকে প্রতিদিনই ফ্লাইট দেয়া হচ্ছে। যার কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে তাদের সঙ্গে মোবাইলে যোগযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) অফিসে গিয়ে জানা গেছে তারা ফ্লাইটে দেশের বাইরে আছেন।
এ প্রসঙ্গে সিভিল এভিয়েশনের সংশ্লিষ্ট শাখার একজন উপপরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিমান থেকে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চলছে। তারা ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার তথ্য সিভিল এভিয়েশনকে লিখিতভাবে জানায়নি। তিনি বলেন, এ জন্য দায়ী বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখা ও সিডিউলিং শাখা। তিনি বলেন, বিষয়টি জানার পর বিমানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এখনও জবাব পাওয়া যায়নি। অপরদিকে তদন্ত সংস্থার প্রধান ক্যাপ্টেন জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পাইলট জানান, উড়োজাহাজটি রানওয়ের নির্দিষ্ট অঞ্চলে গিয়ে যখন টেকঅফ না করে তখন পাইলটদের কিছুই করার থাকে না। ওই মুহূর্তে ফ্লাইটটি থামানোরও জায়গা থাকে না। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.