শাহ মখদুম বিমানবন্দর: উন্নয়নের নামে পকেট উন্নয়ন!

শাহ মখদুম বিমানবন্দর: উন্নয়নের নামে পকেট উন্নয়ন!

রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উন্নয়নের নামে সরকারি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদারদের সহযোগিতায় আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই সরাসরি সরকারি টাকা তছরুপে নেমে পড়েছে। এর মধ্যে চারটি ছোট আকারের পুকুর ভরাট কাজেই ব্যয় করা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকা। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগসহ কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেটিও জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগের ছয় মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে বিমানবন্দরের অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে। তাঁদের দাবি, কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই অনিয়মের তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে বেপরোয়া এই চক্র বিমানবন্দরকে ধ্বংস করে ফেলবে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে গত বছরের ২১ জুন পাঠানো এক অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বা ঢেলে সাজাতে গত তিন-চার বছরে প্রায় ৬৭ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু এসব উন্নয়নকাজের নামে লুটপাটে নামেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা। উন্নয়নকাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যাচ্ছেতাইভাবে কাজ করে কোটি কোটি টাকার বিল তুলছে। কিন্তু বাস্তবে সেসব কাজের নামে অনিয়ম করা হয়েছে। বিমানবন্দরের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত বছরের ১৬ জানুয়ারি কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্থানীয় এমপি আয়েন উদ্দিন। তিনি ওই সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছেও মৌখিক অভিযোগ করেছিলেন।

এ নিয়ে ওই সময় একটি অনুসন্ধানী সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এরপর আরো ভয়াবহ অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, শাহ মখদুম বিমানবন্দরের কার পার্কিংয়ের জায়গাটি ১২ ইঞ্চি ঢালাই করার কথা থাকলেও সেটি করা হয়েছে মাত্র ছয় ইঞ্চি। এ ছাড়া এই ঢালাইয়ের মাঝে ফাঁকা রাখার কথা ছিল চার ইঞ্চি। সেখানে করা হয়েছে ১২ ইঞ্চি। ১ নম্বর ফটক থেকে সীমানাপ্রাচীরটি প্লাস্টার করার কথা থাকলেও সেটি না করেই কাজ শেষ করা হয়েছে। রানওয়ের তিন হাজার ৪০০ ফুট সীমানাপ্রাচীরটিও রং এবং প্লাস্টার করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি না করেই কাজ শেষ করা হয়েছে। অ্যাপরোনের কার্পেটিং করার কথা ছিল ২ দশমিক ৫০ ইঞ্চি। সেখানে করা হয়েছে মাত্র ৫০ ইঞ্চি। বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের স্যানিটারি ফিটিং ও দরজা নতুন লাগানোর কথা থাকলেও সেটি না করে বিল তোলা হয়েছে। রানওয়ের পাশে একটি ছোট আকারের পুকুর ভরাট কাজে ব্যয় দেখানো হয়েছে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু সেখানে ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। ওয়িন ছোকের সামনে আরেকটি পুকুর ভরাটের কাজেও ব্যয় দেখানো হয়েছে এক কোটি ৪৯ লাখ টাকা। কিন্তু সেখানেও সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে ২০ লাখ টাকা। এখানে আরেকটি ছোট আকারের পুকুর ভরাট করতে ব্যয় দেখানো হয়েছে এক কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১০ লাখ টাকা। গ্যালাক্সি হ্যাঙ্গারের সামনে আরেকটি ছোট আকারের পুকুর ভরাট করতে ব্যয় দেখানো হয় এক কোটি টাকা। কিন্তু প্রকৃত ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা।

রানওয়ে ৩৫-এর পাশে দুই হাজার ৪০০ ফুট ড্রেন নির্মাণ কাজের জন্য ব্যয় করা হয় সব মিলিয়ে তিন কোটি টাকা। এই ড্রেনের মাটি দিয়েই অন্যান্য ভরাটকাজ করে কোটি কোটি টাকা তছরুপ করা হয়।

এ ছাড়া বিমানবন্দরের মসজিদ নির্মাণের জন্য পাইলিংয়ের কাজ পরীক্ষা না করেই জাল সনদ দেওয়া হয়েছে। আবার রেস্টহাউস নির্মাণ কাজটির পাইলিংয়ের মাত্র একটি পরীক্ষা করা হলেও অন্যগুলো করা হয়নি। সেখানেও অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

এদিকে বিমানবন্দরের ভারপ্রাপ্ত সম্পত্তি কর্মকর্তা (্এসিই) মাহবুব আলম নিজ নামে তিনতলা একটি বাসা বরাদ্দ না নিয়ে রেডিও মিস্ত্রি রকিব হোসেন ও অফিস সহকারী সাজ্জাদুল ইসলামের নামে বরাদ্দ নিয়ে সেখানে বাস করছেন। মাহবুব আলম সেখানে বাস করে বিমানবন্দরের একটি পুকুরে মাছ চাষ করে সেগুলো নিজেই খেয়ে থাকেন। আবার বিমানবন্দরের দুই একর জমিতে লাগানো কলা ও পেঁপে বিক্রি করা কয়েক লাখ টাকাও আত্মসাৎ করেছেন তিনি। কিন্তু রেডিও মিস্ত্রি আব্দুল হান্নানের মাধ্যমে কর্মচারী ফান্ডে জমা দিয়েছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা।

এ নিয়েও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সুপারভাইজর আব্দুল মতিন নিজেই এই অভিযোগ করেন। কিন্তু ওই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুল হকের কাছে তথ্য অধিকার আইনে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর আবেদন করেছিলেন আব্দুল মতিন।

সরেজমিন বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, কোনো প্রাচীরেই রং করা হয়নি। শুধু প্লাস্টার করে রাখা হয়েছে। আবার টার্মিনাল ভবনের দরজাগুলোও পুরনো। পুকুরগুলো ভরাট করা হয়েছে বালু দিয়ে। পুকুরগুলোর মধ্যে একটি রয়েছে মাঝারি আকারের, যার আয়তন হবে সর্বোচ্চ চার বিঘা। আর অন্যগুলো মিলে হবে সর্বোচ্চ চার বিঘা। চারটি পুকুর মিলে আয়তন হবে সাত থেকে আট বিঘা। সেই হিসাবে প্রতি বিঘা পুকুর ভরাট করতে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

এ ব্যাপারে রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজের তদারককারী ও সিভিল এভিয়েশনের উপসহকারী প্রকৌশলী হাসিবুল হক বলেন, ‘অভিযোগ হয়েছে। তবে নিয়ম মেনেই কাজ করা হয়েছে। কোনো অনিয়ম করা হয়নি। কাজের মান নিয়েও কোনো ছাড় নেই।’

এ ব্যাপারে আব্দুল মতিন বলেন, ‘অনিয়ম মেনে না নিতে পেরে আমি অভিযোগ করেছি। কিন্তু ওই অভিযোগের এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, জানি না।’ এদিকে এসব নিয়ে রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সেতাফুর রহমান বলেন, ‘উন্নয়নকাজের নামে অনিয়ম হয়েছে, এটা ঠিক নয়। নিয়ম অনুযায়ী সব কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু কারা অভিযোগ করেছে বলতে পারব না।’

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.