দেশে এত বিদেশি কর্মী কেন

দেশে এত বিদেশি কর্মী কেন।

একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে বিদেশি কর্মীরা বাংলাদেশ থেকে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। খবরটির উৎস প্রধানত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা)। গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে এ সংস্থা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা ও শিল্প বণিক সমিতি বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, যেকোনো বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করতে চাইলে বিডা থেকে ওয়ার্ক পারমিট নেওয়ার বাধ্যতামূলক বিধান রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বেসরকারি এমনকি কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে লক্ষণীয় হয় যে, এ ধরনের প্রায় ৫ লাখ বিদেশি বাংলাদেশে কাজ করছেন। অথচ বিডা থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ। তাঁদের আয়ের ওপর সরকার যথাযথভাবে করও পাচ্ছে না। কাউকে বেতন দেওয়া হচ্ছে বিদেশে। আবার এ দেশেও অনেককে ডলারে বেতন দেওয়া হয়। অথচ আয়কর বিবরণীতে তাঁরা এটা টাকার অঙ্কে দেখান। আর নিবন্ধনহীনরা তো কিছুই দেখান না। আরও বিস্ময়কর তথ্য পাওয়া যায় যে সরকারের বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি কর্মী নিয়োগে অনেক ক্ষেত্রে বিডা থেকে অনুমতি নেওয়া হয় না। এভাবে এ দেশে কাজ করছেন ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির লোকেরা। বলা হয়, এঁরা দক্ষ কর্মী। আমাদের দেশে তাঁদের মানের কর্মী পাওয়া যায় না। সর্বাধিকসংখ্যক বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিচ্ছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাত, এটিও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। নিয়োগদাতাদের মতে, বাংলাদেশে ফ্যাশন ও ডিজাইনিং, ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনা, বিপণন, সরবরাহ চেইন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি খাতে দক্ষ কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়ে উন্নয়ন, উৎপাদন ও রপ্তানি কার্যক্রম চালু রাখতে হচ্ছে। তবে তাঁরা কি বাধ্যকরী অনুমোদনপত্র নেবেন না? দেবেন না যথাযথ আয়কর?

প্রথমে প্রয়োজনীয়তার দিকটি দেখা যাক। সে প্রতিবেদনেই উল্লেখ আছে আমাদের দেশে প্রতিবছর ২৫ হাজার তরুণ–তরুণী স্নাতক হচ্ছেন। তাঁরা কর্মসংস্থান চান। এটা ঠিক, আমরা জেনে না জেনে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় গলদ সৃষ্টি করেছি। যদিও মেধাবী ছেলেমেয়ে বেশ কিছু আছে, তাঁদের অনেকেই আবার বিদেশে চলে যান। তাই বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতা করার শ্রমশক্তিতে আমরা পিছিয়েই আছি। ফলে বিদেশি বিশেষজ্ঞনির্ভরতা আমাদের রয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, কয়েকটি ফ্রেইট ফরওয়ার্ডিং এজেন্সি ২০০ বিদেশি নাগরিককে নিয়োগ দিয়েছে। এ কাজটি কি কোনো উন্নত প্রযুক্তি বা ব্যবস্থাপনার আওতায় পড়ে? স্বাধীনতার পূর্বকালেও বাঙালিরা ক্লিয়ারিং ফরওয়ার্ডিংয়ের কাজ করে আসছিল। কাজের ব্যাপকতা বেড়েছে। তেমনি বাজারে সরবরাহ বেড়েছে কর্মী। ধারণা করা যায়, তাদের এ নিয়োগে বৈধ কোনো অনুমতি নেই। মনে হয় এ ধরনের কাজে আরও বিদেশি আছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বেজা) প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বৈধ অনুমতি ছাড়া তারা তাদের আওতাধীন জোনগুলোতে কোনো বিদেশিকে কাজ করতে দেবে না। সে জন্য তাদের জোনসমূহে এযাবৎ ১ হাজার কর্মরত বিদেশির যথাযথ ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। এ দৃষ্টান্তটি অন্যরা অনুসরণ করবে না কেন? এটা তো কোনো দয়া বা অনুকম্পা দেখানোর বিষয় নয়। সরকারের বিধিবিধান অনুসরণ করা সবার জন্য বাধ্যকরী। অবৈধ বিদেশি শ্রমিক কমবেশি সব দেশেই আছে। তবে কোথাও কি ৮০ শতাংশ বিদেশি শ্রমিক রয়েছে! নিশ্চয়ই নয়। ধারণা করা হয়, ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে কোনো দেশে অবৈধ বিদেশি কর্মী থাকে। এখানে উল্লেখ করতে হবে, এ অনুমতির সঙ্গে সরকারের কর্তৃত্বের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান ও বিদেশি কর্মীদের আয়কর প্রদানের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট রয়েছে।

স্থানীয় পর্যায়ে অনেকের সহযোগিতা না থাকলে এমনটা ঘটত না। বিদেশিরা এ দেশে আসেন ভিসা নিয়েই। ওয়ার্ক পারমিট থাকলে সে ভিসার মেয়াদ হয় কাজের সঙ্গে সংগতি রেখে। নচেৎ মাল্টিপল এন্ট্রি ভিজিট ভিসাতেও একনাগাড়ে তিন মাসের অধিক কোনো বিদেশি থাকতে পারেন না। অবশ্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ সে সময়সীমা বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে। এ ব্যবস্থাটির ব্যাপক অপব্যবহার বেআইনি বিদেশি কর্মীর বিপুল হারে উপস্থিতিতে অবদান রাখছে বলে ধারণা করা যায়। উদ্যোক্তা শ্রেণি ও ব্যবসায়ীরা দক্ষ লোক খুঁজবেন, খুব স্বাভাবিক। তবে বিদেশি দক্ষ কর্মী নিয়োগের পাশাপাশি দেশি কর্মীদের সে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করার সময়াবদ্ধ দায়িত্ব তাঁদেরই নিতে হবে। বিডার অনুমতিপত্রের শর্তে কী আছে জানা নেই। এ ধরনের বিধান থাকাই স্বাভাবিক। না থাকলে করতে হবে। আর একেবারেই অনুমতি ছাড়া কাজ করছেন, তাঁরাসহ নিয়োগদাতারা কিন্তু আইনের বিপরীতে রয়েছেন। সরকারি প্রকল্পে এমনটি কীভাবে হয়, এটা বোধগম্য হচ্ছে না। এর দায়ভার নিতে হবে প্রকল্প পরিচালক ও মন্ত্রণালয়ের সচিবকে। প্রকল্প দলিলে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আবশ্যকতার কথা উল্লেখ থাকলেই হবে না। এ ধরনের কর্মী দেশে পাওয়া যাচ্ছে না, এ বিষয়ে বিডাকে সন্তুষ্ট হতে হবে। অবশ্য এটা নিশ্চিত করতে হবে, প্রকৃত চাহিদা যাঁদের রয়েছে, তাঁরা যেন বিডাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন।

বিদেশিদের শ্রমমূল্য হিসেবে আমাদের দেশ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর যায়। ঠিক তেমনি আমাদের প্রবাসী কর্মীরাও পাঠান বৈদেশিক মুদ্রা। তার পরিমাণ ছিল ২০১৮ সালে সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার। কিছু প্রণোদনা দেওয়ায় এ বছরে এটা কিছু বাড়বে বলে লক্ষণীয় হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্ট মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) একটি তথ্যমতে, ১৯৭৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আমরা ১ কোটি ২১ লাখ ৯৯ হাজার লোককে সৌদি আরব, উপসাগরীয় দেশসমূহ, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে পাঠিয়েছি। তাঁরা সবাই অস্থায়ী অধিবাসী। সময়ান্তরে স্বাভাবিকভাবেই ফিরে এসেছেন অনেকেই। তাঁদের ঠিক কত লোক এখন কার্যরত আছেন, এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ২১টি দেশে ২৪ লাখ বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাসরত আছেন বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়। যৌক্তিকভাবেই ধারণা করা যায়, স্থায়ী–অস্থায়ী সব মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি প্রবাসে আছেন।

প্রবাসী আয় বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় এবং বিশ্বে একাদশ। আর এ আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে যাচ্ছেন মাত্র ৫ লাখ বিদেশি কর্মী। অন্যদিকে তাঁদের শতকরা ৮০ জনের এ দেশে কাজ করার বৈধতা নেই। দিচ্ছেন না আয়কর। বৈধরাও ফাঁকি দিয়ে চলছেন অনেকে। এ ব্যাপারটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সুযোগ নেই—এমনটা মনে হয় না। সরকারের সব সংস্থাই তো কার্যকর রয়েছে বলে দাবি করা হয়। শিল্প–বাণিজ্য ও উন্নয়ন কার্যক্রমে আতঙ্ক সৃষ্টি করা অযাচিত। এতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তবে দৃঢ়তার সঙ্গে ধীরে ধীরে আইন কার্যকর করাকে আতঙ্ক সৃষ্টি বলা যাবে না। ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের নিয়ে বৈঠক করতে হবে। আইনের বিধানে কোনো বিচ্যুতি থাকলে, তা–ও সংশোধন করা প্রয়োজন। বিনা অনুমতিতে বিদেশি কর্মী কাজ করলে সে কর্মী ও তাঁর নিয়োগদাতা দুজনকেই আইনের আওতায় আনা হবে বলে একটি কার্যকর বার্তা দেওয়া যায়। একটি সময়ের পর সে বার্তাটি যে অর্থবহ, তা বোঝাতে শুরু করতে হবে। ভিজিট ভিসায় আসা লোকদের ভিসা নবায়নে যথেষ্ট পরীক্ষা–নিরীক্ষা প্রয়োজন। নচেৎ আমাদের বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতার সুযোগে বিদেশি কর্মী ও তাঁদের প্রেরিত আয় নিজ দেশে পাঠানোর পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। আমাদের প্রবাসী কর্মীদের হাড়ভাঙা খাটুনির টাকার একটি বড় অংশ নেবেন তাঁরাই। লাভের গুড় খাবে পিঁপড়ায়।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.