নিষেধাজ্ঞা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে ॥ বিমানমন্ত্রী

Aviary Photo_131021392875559848যুক্তরাজ্যের ঢাকার হাইকমিশন, এ্যাভিয়েশন টিম এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নয়নে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সম্মত কর্মপরিকল্পনাকে আরও ত্বরান্বিত করতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দিনের একটি সময়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও সংশ্লিষ্ট সচিব বিমান বন্দরে অফিস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুক্তরাজ্যকে ইঙ্গিত করে রাশেদ খান মেনন বলেন, এ ব্যাপারে তারা ভাল করে জানেন যে, এটার একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। আমাদের যেমন আছে তেমনি তাদেরও (যুক্তরাজ্যের) আছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে তারা চিঠি দিয়েছেন। এখন দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে চিঠি বিনিময় হচ্ছে। আশা করছি, যে কাজটুকু বাকি আছে তা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে মিলেই সম্পন্ন করা হবে।

বৃহস্পতিবার এক জরুরী সভায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপির সভাপতিত্বে শাহজালাল বিমানবন্দরে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এদিকে, কার্গো চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাজ্যে তৈরি পোশাক রফতানি কমতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। তবে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে এ সঙ্কট কেটে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, আমি মনে করি, এটি সাময়িক সমস্যা। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। দেশের বাণিজ্যের অবস্থা অনেক ভাল। তাই এ নিষেধাজ্ঞায় তেমন কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বৃহস্পতিবার দুপুরে বিজিএমইএ ভবনে কার্গো চলাচলের উপর চলমান সঙ্কট নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সভাপতি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান। আর একই সময়ে সচিবালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা বলেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তেমন কিছু করার নেই। আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সে দেশের সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়টি তাড়াতাড়ি সমাধান করলে আমরা সুবিধা পাব। তবে এ নিষেধাজ্ঞায় রফতানির উপর এখনই কোন প্রভাব পড়বে না। বাংলাদেশের রফতানি অনেক ভাল অবস্থায় রয়েছে।

এদিকে, সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, তিন মাস আগে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কার্গো বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আবার এখন নিরাপত্তাজনিত কারণে যুক্তরাজ্যও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল। এতে আমাদের যে শুধু আর্থিক ক্ষতি হবে তাই না, ইমেজও সঙ্কটের মুখে পড়ল, যা আমাদের পোশাক শিল্পকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

তিনি বলেন, এতদিন আমরা সরাসরি যুক্তরাজ্যে পণ্য পাঠাতে পারতাম। কিন্তু যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় এখন দুবাই, হংকং হয়ে যুক্তরাজ্যে পণ্য পাঠাতে হবে। সরকারকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানান বিজিএমইএ সভাপতি। আর নয়ত সামনে পোশাক শিল্পের জন্য আরও কঠিন দিন অপেক্ষা করছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

সিদ্দিকুর রহমান একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। যা ওই সময়ের মোট পোশাক রফতানির ১১ দশমিক ৩৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এই বাজারে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যুক্তরাজ্যের বাজার বাংলাদেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই বাজারে কোন রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ুক তা কাম্য নয়।

বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, বিভিন্ন কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমুদ্র পথে পণ্য পাঠানো সম্ভব হয় না। তখন নিজেদের খরচে বিমানে পণ্য পাঠাতে হয়। যুক্তরাজ্যের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন একদিকে খরচ বাড়বে, অন্যদিকে সময়ও বেশি লাগবে। এতে আমাদের প্রতিযোগী সক্ষমতাও কমে আসবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মোট রফতানির প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পণ্য প্রতিবছর উড়োজাহাজে পাঠাতে হয়। এ সময় সরকারকে দ্রুত হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানান তিনি। এ ছাড়া বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদারে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা যুক্তরাজ্য সরকারকে অবহিত করে ৩১ মার্চ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানান বিজিএমইএ সভাপতি। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাছির ও পরিচালক মিরান আলী।

প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক মানদ-ে নিরাপত্তার ঘাটতি থাকায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাজ্য। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে দুই দেশের সম্মত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপত্তা জোরদারের কাজ শুরু না হলে বাংলাদেশ বিমানের যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি যাত্রীবাহী ফ্লাইটও নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া এক চিঠিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এমন আভাস দিয়েছেন।

এর আগে গত বছরের নবেম্বরে ঢাকা থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে অস্ট্রেলিয়া।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর বৈঠক ॥ সচিবালয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্র এখনও বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে না দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, রোজকেয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ তাদের শর্ত পূর্ণ করতে পারবে না বলে তার ধারণা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি ফিরে পেতে যেসব করণীয় ছিল তার সবই করা হয়েছে। পরিদর্শনের পর কিছু কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেগুলো আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। তাতে আমাদের ৫০ হাজার শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু যারা ক্রেতা তারা এখন সন্তোষ প্রকাশ করেছে, আমাদের কোন কারখানাই ঝুঁকিপূর্ণ নয়।

রানা প্লাজা ধসের পর প্রায় তিন বছর চলে গেছে। এর মধ্যে কোন দুর্ঘটনা হয়নি। আমরা যদি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে পরবর্তী ধাপে উন্নীতও হই, তাহলে আমাদের স্ট্যাটাস কী হবে, সেটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনই আমাদের ফেভারে চিন্তা করতে শুরু করেছে। সব শর্ত পূরণে হওয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা ফিরে না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তোফায়েল আহমেদ বলেন, কেন আমরা পাচ্ছি না, তার উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের বার্নিকাট দিয়েছেন, তিনি তার উত্তরে তা বলেছেন। যে কথাটা মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, আমাদের অনেক উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতি দরকার। সেই উন্নতিটা কী? আমাদের ইপিজেডে আমরা যে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন করেছি সেখানে সব কিছুই আছে। ১০-১৫ হাজার টাকার কমে কেউ বেতন পায় না। শ্রমিকদের তরফ থেকে কোন অভিযোগ নাই। তিনি আরও বলেন, ২০৫০ সালের মধ্য আমরা যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানির টার্গেট করেছি, সেখানে আমরা পৌঁছাব। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা সামান্য জিএসপি পেতাম ২৩-২৫ মিলিয়ন ডলার, যেখানে রফতানি হয় ৬ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাকে আমরা জিএসপি সুবিধা পেতাম না।

বিমান বন্দরে জরুরী সভা ॥ কার্গো পরিবহনে যুক্তরাজ্যের সাময়িক নিষেধাজ্ঞাসহ বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন, কার্গো কমপ্লেক্সের সুবিধাদি বৃদ্ধি এবং ইতিপূর্বে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ মূল্যায়নে এ জরুরী সভায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী, সিভিল এ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল সানাউল হক, বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের ভারপ্রাপ্ত এমডি আসাদুজ্জামানসহ মন্ত্রণালয়, সিভিল এ্যাভিয়েশন এবং বিমান বাংলাদেশের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

সভায় জানানো হয়, যুক্তরাজ্যের ঢাকার হাইকমিশন, এ্যাভিয়েশন টিম এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে। আধুনিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহে গত ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় ৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। বাংলাদেশের গৃহীত ব্যবস্থাদি সন্তোষজনক বলে ব্রিটিশ হাইকমিশন জানিয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সাময়িক নিষেধাজ্ঞা অনাকাক্সিক্ষত। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবস্থার উন্নয়নে সিভিল এ্যাভিয়েশন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আরও নিবিড়ভাবে কাজ করবে এবং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পুরো কর্মকা-কে মনিটরিং করা হবে।

সূত্রঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.