শরীরের রক্তদূষণের ১১ লক্ষণ

শরীরের রক্তদূষণের ১১ লক্ষণ।

সেপসিস বা ব্লাড পয়জনিং বা রক্তদূষণ হলো প্রাণঘাতী দশা, কিন্তু এটি শনাক্ত করা কঠিন। এ নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে আপনার সর্বোত্তম সুরক্ষা হলো সেপসিসের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া। এ প্রতিবেদনে সেপসিসের ১১ উপসর্গ আলোচনা করা হলো যা অবহেলা করা উচিত নয়।

* উচ্চমাত্রার জ্বর
সেপসিস ইনফেকশন হলো একটি প্রাণনাশক দশা, যেখানে শরীরের কোনো স্থানের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে। অনেকেই এ ইনফেকশনে মারা যায়। দুর্বল ইমিউন সিস্টেমের লোকদের সেপসিস হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি হলেও নিউমোনিয়ার মতো প্রাথমিক ইনফেকশন, মূত্রতন্ত্রের ইনফেকশন অথবা এমনকি হাত বা পায়ের ক্ষত থেকেও যে কারো সেপসিস হতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে সেপসিস ধরা পড়লে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সহজেই চিকিৎসা করা যায়, কিন্তু সেপসিসের উপসর্গকে অন্য দশার উপসর্গ ভেবে ভুল হতে পারে- তাই প্রায়ক্ষেত্রে অগ্রসর পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত এটি অনির্ণীত থেকে যেতে পারে। একারণে সেপসিসের লক্ষণগুলো জেনে নেওয়া উচিত- রক্তদূষণের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গ হলো উচ্চমাত্রার জ্বর। রক্তদূষণ বিশেষজ্ঞ ও নিউ জার্সির ক্যামডেনে অবস্থিত কুপার ইউনিভার্সিটি হেলথ কেয়ারের ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিনের সভাপতি আর. ফিলিপ ডেলিনজার বলেন, ‘সেপসিস তখন ঘটে যখন সংক্রমিত অণুজীবের বিষ রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে ও প্রদাহ ঘটায়। ইনফেকশন প্ররোচিত সিস্টেমিক প্রদাহের সবচেয়ে নির্দিষ্ট লক্ষণ হলো জ্বর।’

* শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়া
আপনি ইতোমধ্যে জেনেছেন যে রক্তদূষণে উচ্চমাত্রার জ্বর হয়, কিন্তু সেপসিস ইনফেকশন এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করতে পারে। রক্তদূষণের প্রধান গবেষক ও আটলান্টায় অবস্থিত ইমোরি ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের সার্জন ক্রেইগ কুপারস্মিথ বলেন, ‘খুব বিরলক্ষেত্রে শরীর কোনো ইনফেকশনের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখায় শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে।’ গবেষণায় পাওয়া গেছে যে খুব নিম্ন তাপমাত্রা সেপসিসের মারাত্মক পর্যায় অথবা এ দশা আরো খারাপ হচ্ছে তা নির্দেশ করতে পারে। গ্লোবাল সেপসিস অ্যালায়ান্স থার্মোমিটারের রিডআউট ৯৬.৮ এর নিচে নেমে যাওয়াকে দুশ্চিন্তার বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছে।

* শরীরে ঠান্ডা অনুভব
সেপসিস ইনফেকশনের অন্যতম উপসর্গ হলো প্রায়ক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রার সঙ্গে শরীরে ঠান্ডা অনুভব করা। আপনার এ উপসর্গ থাকলে অবিলম্বে ডাক্তারকে জানাতে ভুলবেন না। ডা. ডেলিনজার বলেন, ‘ঠান্ডার অনুভূতি হলো ব্যক্তিগত। একজন রোগী শরীরে ঠান্ডা অনুভব করতে পারে, কিন্তু ডাক্তারের পক্ষে তা শনাক্ত করা সম্ভব নাও হতে পারে।’ জ্বর ও ঠান্ডা অনুভূতিকে অন্য ইনফেকশনের উপসর্গ ভেবে ভুল হতে পারে, যেমন- ফ্লু। এ উপসর্গের সঙ্গে রক্তদূষণের অন্যান্য উপসর্গ যত বেশি থাকবে, এ দশাটি সেপসিস ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। তাই জ্বর ও ঠান্ডা অনুভূতির সঙ্গে সেপসিসের অন্যান্য উপসর্গের উপস্থিতি আসলেই দুশ্চিন্তা করার মতো বিষয়।

* ব্যথা
সেপসিস ইনফেকশন জনিত ব্যথা শরীরের সর্বত্র অথবা শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে স্থানে অনুভব হতে পারে। ১২ বছরের শিশু রোরি স্টাউন্টনের সেপসিস হয়েছিল- তার অন্যতম উপসর্গ ছিল পাকস্থলি ও পায়ে ব্যথা, যাকে ডাক্তাররা অবহেলা করেছিল। এ শিশুটির সেপসিস হয়েছিল জিম ক্লাসে সৃষ্ট বাহুর ক্ষত থেকে। পরদিন সকালে সে ব্যথার অভিযোগ করেছিল। অবস্থা গুরুতর হওয়াতে সন্ধ্যায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। এর দুদিন পর রোরি মারা যায়। তাই হঠাৎ করে কোনো ব্যথা অনুভূত হলে অবহেলা করা উচিত নয়। রোরির পিতামাতা সেপসিস সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে রোরি স্টাউন্টন ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন।

* নিম্ন রক্তচাপ
নিম্ন রক্তচাপ হতে পারে এ ইনফেকশনের সবচেয়ে মারাত্মক প্রকাশ এবং এটি সবচেয়ে গুরুতর পর্যায় সেপটিক শক নির্দেশ করতে পারে, বলেন ডা. ডেলিনজার। সেপসিসের সময় রক্তচাপ কমে যায়, কারণ রক্তনালীগুলো তরল হারাতে শুরু করে এবং শিরা ও ধমনী শিথিল হয়ে যায়। শরীরে যতটুকু রক্ত বহন হওয়া উচিত ততটুকু হয় না। ডা. ডেলিনজার বলেন, ‘সেপসিসের সবচেয়ে তীব্র পর্যায়ে তরল প্রতিস্থাপনের প্রতি নিম্ন রক্তচাপ সাড়া দেয় না এবং রক্তচাপ বাড়াতে রোগীদের শিরায় ওষুধ ইনজেক্ট করার প্রয়োজন রয়েছে। সেপসিস নির্ণায়ক ডাক্তারদের জন্য নতুন মেডিক্যাল গাইডলাইন্সে রোগীদের সিস্টোলিক রক্তচাপ (ওপরের সংখ্যা) ১০০ এর নিচে নেমে গেছে কিনা তা লক্ষ্য করতে বলা হয়েছে।

* দ্রুত হৃদস্পন্দন
সেপটিক ইনফেকশন থাকলে হৃদপিণ্ড অধিক কার্যকরভাবে রক্ত সরবরাহ করার চেষ্টা করে, যাতে শরীর এ অসুস্থতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। ডা. কুপারস্মিথ বলেন, ‘অসুস্থতার প্রতি শরীরের একটি কমন প্রতিক্রিয়া হলো হৃদপিণ্ড থেকে বর্ধিত পরিমাণে রক্ত পাম্প হওয়া। একাজটি করার সময় হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে যায়। এ বর্ধিত রক্ত শরীরকে এ ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ভালো সুযোগ দেয়।’ প্রতি মিনিটে ৯০ বা এর বেশি হৃদস্পন্দন হতে পারে সেপসিসের অন্যতম লক্ষণ, মায়ো ক্লিনিক অনুসারে।

* শ্বাসকষ্ট
নতুন মেডিক্যাল গাইডলাইন্স অনুসারে, সেপসিসের আরেকটি লক্ষণ হলো প্রতি মিনিটে শ্বাসের হার ২২ বা এর বেশি। এ প্রসঙ্গে ডা. কুপারস্মিথ বলেন, ‘দুটি কারণে সেপসিসে শ্বাস দ্রুত হয়। একটি কারণ হলো ইনফেকশনটি ফুসফুসে, যা অক্সিজেনের ঘাটতিতে ফেলে- এ ধরনের একটি ইনফেকশন হলো নিউমোনিয়া এবং এটি হলো সেপসিসের সবচেয়ে কমন কারণ।’ কিন্তু ফুসফুস জনিত ইনফেকশনের কারণে এ দশা না হলেও সেপসিসের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে শরীরে অক্সিজেনের প্রয়োজন বেড়ে যায় এবং কার্বন-ডাইঅক্সাইড রিলিজের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পায়। এ সময় শ্বাসকার্য দ্রুত হয় ও শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয়।

* বিবর্ণ বা অস্বাভাবিক বর্ণের ত্বক
যেহেতু শরীর এটির শক্তি ও সম্পদ মস্তিষ্ক ও হৃদপিণ্ডে ডাইভার্ট করে, তাই এটি কম গুরুত্বপূর্ণ অর্গানসমূহকে উপেক্ষা করতে শুরু করে। ডা. কুপারস্মিথ বলেন, ‘যখন কোনো রোগীর সেপটিক হয়, শরীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্গানসমূহে রক্ত প্রবাহিত করে এবং বেঁচে থাকার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ অর্গানসমূহে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দেয়। রক্তপ্রবাহে কমে যাওয়ার কারণে ত্বক বিবর্ণ হয়ে যেতে পারে।’ অরল্যাথ স্টাউন্টন লক্ষ্য করেছিলেন যে তার ছেলে রোরির ত্বক অস্বাভাবিক বর্ণের হয়ে গিয়েছিল। রোরির মা বলেন, ‘ডাক্তাররা মনে করেননি যে সেপসিসের কারণে এমনটা হয়েছে এবং একারণে তারা ডাড়াতাড়ি এ ইনফেকশন শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।’

* ঘুমঘুম ভাব বা মানসিক জড়তা
ডা. ডেলিনজার বলেন, এ উপসর্গ বয়স্ক সেপসিস রোগীদের মধ্যে বেশি কমন। কিন্তু অরল্যাথ স্টাউন্টন তার পুত্র রোরির মধ্যে ঘুমঘুম ভাব লক্ষ্য করেছিলেন। যখন আপনি ক্লান্ত হন অথবা ঠান্ডা লাগে, তখন ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য আপনার শরীরের বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। কিন্তু ডা. কুপারস্মিথ বলেন, নিম্ন রক্তচাপের কারণেও আপনার ঘুমঘুম ভাব বা মানসিক জড়তা হতে পারে। তিনি যোগ করেন, ‘যখন আপনার রক্তচাপ একটি নির্দিষ্ট পয়েন্টের নিচে নেমে যায়, তখন আপনার মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত রক্তপ্রবাহ পাবেন না- এর ফলে আপনার ঘুমঘুম ভাব অথবা মানসিক জড়তা হতে পারে।’

* মূত্রত্যাগের পরিমাণ কমে যাওয়া
পানিশূন্যতার কারণে সেপসিস রোগীদের মূত্রত্যাগের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এর কারণ হলো- কেউ ভালো অনুভব না করলে বা বমিবমি ভাব হলে বা ডায়রিয়া হলে কম খায় ও পান করে। এছাড়া রক্তনালির একটি মারাত্মক দশা লিকি ব্লাড ভেসেলের কারণেও এমনটা হতে পারে, যেখানে রক্তনালির ছিদ্র দিয়ে তরল ও রক্ত বেরিয়ে যায়।

* বমি, বমিবমি ভাব ও ডায়রিয়া
দুর্ভাগ্যজনকভাবে রোরির ডাক্তাররা তার পরিপাকতান্ত্রিক উপসর্গকে অবহেলা করেছিলেন- তারা ভেবেছিলেন যে এটি পাকস্থলীর ভাইরাস ছাড়া কিছুই নয়। কোনো প্রাথমিক আন্ত্রিক ইনফেকশন থেকে আন্ত্রিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, যা সেপসিসের দিকে ধাবিত হতে পারে। অথবা ডা. কুপার স্মিথের মতে, সেপসিস রোগীদের শরীর অন্ত্রের মতো কম গুরুত্বপূর্ণ অর্গানকে উপেক্ষা করে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অর্গানে বেশি রক্ত পাঠায় বলে অপর্যাপ্ত রক্তপ্রবাহের কারণে এসব উপসর্গ প্রকাশ পেতে পারে। সেপসিসের কিছু উপসর্গ ফ্লু বা ভাইরাসের অনুরূপ। তাই রোগীদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে ডাক্তারদেরকে একটি প্রশ্ন আত্মস্থ ও চর্চা করতে হবে- এটা কি সেপসিস?

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.