ঋণের সুদ কমাতে লাগাম টানুন খেলাপিরঃ অর্থমন্ত্রী

ঋণের সুদ কমাতে লাগাম টানুন খেলাপিরঃ অর্থমন্ত্রী

খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ঋণের সুদহার কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এছাড়া ঋণের সুদহার কমাতে কম সুদে আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্র তৈরি এবং বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান বাড়ানোর জন্য বিকল্প তহবিল সৃষ্টির পথ খোঁজার নির্দেশনা দিয়েছেন।
রোববার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ শীর্ষপর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তাকে ডেকে এসব নির্দেশনা দেন অর্থমন্ত্রী। এ নির্দেশ পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকটি বিভাগ এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে।
তারা খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর কী পরিমাণ তহবিল আটকে আছে, সেগুলো কীভাবে অবমুক্ত করে সচল করা যায়, এ বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
এরই মধ্যে নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রচলিত আইন সংশোধনের বিষয়েও কথা বলেছেন।
এ বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে অর্থঋণ আদালত ও দেউলিয়া আদালত আইনের প্রয়োগ আরও কঠোর করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সংশোধিত খসড়া প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেটি নিয়েও নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের জিডিপির আকার বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। এ কারণে ঋণর চাহিদাও বেড়েছে। সে তুলনায় জিডিপির শতকরা হারে সঞ্চয় বাড়েনি।
এছাড়া খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকিং খাতে তহবিলের সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে ঋণের সুদের হার কমছে না। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান দিতে পারছে না।
এছাড়া জাল-জালিয়াতির কারণে কিছু অখ্যাত শিল্পগ্রুপ মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে কয়েকটি ব্যাংককে বিপাকে ফেলেছে। ফলে ওইসব ব্যাংকও তহবিল সংকটে ভুগছে। এর মধ্যে রয়েছে জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক।
অন্যান্য ব্যাংকেও বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের পরিমাণ কমে গেছে। এসব কারণে ঋণের জোগান বাড়াতে সরকারি আমানতের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বিকল্প উৎস থেকে তহবিল বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, ব্যাংকিং খাতে তারল্য বাড়ানোর চারটি পথ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল সরকারের রাজস্ব আয়, অন্যান্য খাত থেকে আয় বাড়লে এবং বৈদেশিক উৎস থেকে সরকারের তহবিলের জোগান বাড়লে সেগুলো ব্যাংকিং খাতে তারল্যের জোগান বাড়াবে। রফতানি আয় ও প্রবাসীদের রেমিটেন্স বাড়লেও ব্যাংকে টাকার প্রবাহ বাড়বে।
সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ বাড়লেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া খেলাপি ঋণের কারণে আটকে থাকা তহবিল ছাড় করাতে পারলেও ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ বাড়াবে। বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে নেই, সরকারের হাতে রয়েছে।
এসব খাত থেকে দ্রুত তহবিলের জোগান বাড়ানোও সম্ভব হবে না। এজন্য বিকল্প উৎস অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণ বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক থেকে তহবিল সংগ্রহ করে তা দিয়ে শিল্প খাতে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ঋণের সুদের হার কমানোর উদ্যোগটি প্রক্রিয়াধীন আছে। এটি নিয়ে এখনও কাজ হচ্ছে। আশা করি সামনে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
সূত্র জানায়, খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর এখন মোটা অঙ্কের তহবিল আটকে রয়েছে। এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর বড় অংশই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।
এছাড়া সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ, নিুমান ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়। এসব মিলে ব্যাংকগুলোর প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা আটকে আছে। রাইট অফ করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী শতভাগ প্রভিশন রেখে ঋণ রাইট অফ করতে হয়। এ হিসাবে ওই ঋণের বিপরীতে আরও ৫৬ হাজার কোটি টাকার তহবিল আটকে আছে। এসব ঋণের বিপরীতে মামলা পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, জামানত পাহারা দেয়া, আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও অর্থ খরচ হচ্ছে।
এছাড়া এসব আমানতের বিপরীতে গ্রাহকদের সুদ দিতে হচ্ছে নিয়মিত। অথচ এর বিপরীতে ব্যাংকের কোনো আয় নেই। ফলে ব্যাংক সব দিক থেকে বিপাকে পড়েছে।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণ যাতে আর এক টাকাও না বাড়ে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসকে (বিএবি)। এরপর থেকে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীরাও বৈঠক করেছেন কীভাবে খেলাপি ঋণ কমানো যায় সে পদ্ধতি নিয়ে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো এখন খেলাপি ঋণের ধরন শনাক্ত করছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে। যেসব খেলাপি বর্তমানে ব্যবসায় নেই, তাদের বন্ধকি সম্পদ বিক্রি করে খেলাপি ঋণ আদায় করার উদ্যোগ নেয়া এবং যেসব খেলাপি এখন ব্যবসা করছে তাদের ঋণ পরিশোধে জোরালো তাগিদ দেয়া হবে।
এ বিষয়ে বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে সব পক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিচার বিভাগকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। কেননা খেলাপি ঋণের বড় অংশ আইনি জটিলতায় আটকে রয়েছে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.