বিমানে নারী বৈমানিককে নিয়ে তুঘলকি কান্ড

capt-farialবাংলাদেশ বিমানে এক নারী বৈমানিকের রুট ট্রেনিংয়ে রহস্যজনক ফেলের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় উঠেছে। জানাগেছে,  বিমানের ওই বৈমানিক রুট চেকের সময় তার প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেনের রোষাণলের শিকার হয়েছেন। ওই ক্যাপ্টেনের তত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিলে এর ফলাফল উল্টো হবে এমন আশংকা প্রকাশ করার পরও তিনি সুবিচার পাননি। উল্টো তাকে বাধ্য করা হয় ওই ক্যাপ্টেনের অধীনে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে। এতে তিনি ভাল করার পরও প্রশিক্ষক তাকে অন্যায়ভাবে ফেল করিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠে। তিনি এর প্রতিবাদ করলে তাকে মানসিক রোগী বলে অভিযুক্ত করে পাঠানো হয় মনোচিকিৎসকের কাছে। তাতেও থামেননি বিমানের ফ্লাইট পরিচালনা শাখার শীর্ষব্যক্তি। তখন অন্যায় অযৌক্তিকভাবে ওই ফার্স্ট অফিসারের বেতনভাতাদি বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে অনন্যোপায় হয়ে তিনি ওই এ ঘটনা লিখে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ৮ পৃষ্টার একটি অভিযোগ জানিয়ে সুষ্টু বিচার ও তদন্ত দাবি করেন।
ঘটনাটি ইতিমধ্যে বিমান ম্যানেজমেন্ট, পরিচালনা পর্যদ পেরিয়ে মন্ত্রনালয় পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই ঘটনায় বিমানের টপ টু বটম সবাই বিব্রত বোধ করছেন। কেউ মুখ খুলতে রাজি হচ্ছে না। অভিযোগ আছে এখন বিমানের ফ্লাইট অপারেশন শাখার একটি সিন্ডিকেট তাকে চাকরীচ্যুত করার হুমকি দিচ্ছে । তারা কো পাইলটকে তার আবেদন প্রত্যাহার করে নেয়ার হুমকী দিচ্ছে। বিমানের এই নারী বৈমানিকের নাম ফারিয়াল আহমেদ।
ফ্লাইট অপারেশন শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, বিমানের একজন প্রভাবশালী পাইলটের ভাই হচ্ছেন বিমান ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তা। একারণে ম্যানেজমেন্টও ক্যাপ্টেন ফারিয়ালের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন ধরনের তদন্ত কমিটি গঠন করা হযনি।
বিমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দিক আহম্মেদ বলেন, ফারিয়ালের বেতন বন্ধের নির্দেশ প্রত্যাহারের জন্য তিনি ফ্লাইট অপারেশন  বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ফারিয়ালকে আবার অপারেশনে ফিরে আসতে হলে আগে ইন্সট্রাকটরের দেয়া ফেল রিপোর্ট মেনে নিতে হবে।  এরপর তাকে দ্বিতীয় দফায় অপর একজন ইন্সট্রাকটেরর অধীনে রুট চেক ট্রেনিংয়ে পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।
বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, পুরো ঘটনাটি তিনি শুনেছেন। সোমবার বিকালে তিনি বিমান এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদকে তার কার্যালয়ে ডেকে এনে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। বৈঠকে তিনি অবিলম্বে এই ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, যে কোন ব্যক্তি যদি মনে করেন ম্যানেজমেন্টের কোন সিদ্ধান্ত তার বিরুদ্ধে গেছে তাহলে এর প্রতিকারের জন্য তিনি দরখান্ত কিংবা অভিযোগ জানাতেই পারেন। একারণে তার বেতনভাতা বন্ধ করে দেয়া অন্যায় ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। এটা শাস্তি যোগ্য অপরাধ। বিষয়টি তিনি বিমান পর্যদ চেয়ারম্যান ও বিমান এমডিকে জানিয়েছেন বলেও জানান।
বিমান প্রশাসন বিভাগের একজন কর্মকর্তা ফারিয়ালের দেয়া অভিযোগের বরাত দিয়ে জানান, নারী বৈমানিক ফারিয়ালের  রুট চেকের প্রশিক্ষক ছিলেন বিমানের চুক্তিভিত্তিক বৈমানিক ক্যাপ্টেন ইন্সট্রাকটর কামরুল হাসান জোয়ারদার। তার বিরুদ্ধে এর আগেও অসংখ্য অভিযোগ বিমানে ফাইল বন্দি হয়ে আছে। দুই দফা বিয়ে করলেও নারী ঘটিত অভিযোগে তার দুই স্ত্রীই তাকে ডিবোর্স দিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বেসেলর জীবন যাপন করছেন। জানাগেছে, প্রথম বিয়ের পর তিনি বিমানের একজন কেবিন ক্রুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই সম্পর্ক জানাজানি হলে তার প্রথম স্ত্রী তাকে ডিবোর্স দিয়ে কানাডা চলে যান। এনিয়ে থানায় মামলাও হয়।

এরপর তিনি যে কেবিন ক্রুর সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিলেন তাকেই বিয়ে করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিয়ের পরও বিবাহিত থাকা অবস্থায় তিনি বিমানের একজন জুনিয়র পাইলটের স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এটিও জানজানি হয়ে যায়।  এরপর দ্বিতীয় স্ত্রীও তাকে ডিবোর্স দিয়ে যুক্তরাস্ট্রে পাড়ি জমান। এরপর থেকেই লালমাটিয়ার বাড়িতে তিনি বেসেলর জীবন যাপন শুরু করেন।
ফ্লাইট অপারেশন শাখা সুত্রে জানাগেছে ২০০৮ সালে নানা অভিযোগে ক্যাপ্টেন জোয়ারদারকে চাকরীচ্যুত করা হয়। কিন্তু এই চাকরীচ্যুতির বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা করেন। মামলায় তিনি জয়ী হয়ে ২০১১ সালে আবার বিমানে যোগদান করেন। এরপর ২০১৩ সালে তিনি চাকরী থেকে অবসরে যান। ওইসময় তিনি চুক্তিভিত্তিক চাকরীর চেষ্টা করেও বিমানে আর যোগদান করতে পারেননি। জানাগেছে ২০১৪ সালে তিনি বাপার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন মাহবুরের সহযোগিতায় বিমানে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ পান। বিমানের আইন অনুযায়ী চুক্তিভিত্তিক কোন পাইলট ইন্সট্রাকটর হতে পারেন না। কিন্তু বাপার প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্টতার সুবাদে তাকে ইন্সট্রাকটর হিসাবে নিয়োগ দেয় বিমান ম্যানেজমেন্ট।
এ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন জোয়ারদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রুট চেকে পাস করার জন্য যে সব শর্ত পুরণ করতে হয় কো পাইলট ফারিয়াল কোন শর্তই পুরণ করতে পারেননি। একারণে তিনি ফেল করেছেন। এখানে কোন ধরনের খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন গ্রাউন্ডেট থাকার কারণে তিনি কো-পাইলট হিসাবে আনফিট ছিলেন। ককপিটে বসেই তিনি অসংলগ্ন আচরণ করেন। একটি যাত্রী বাহী ফ্লাইটে ওই রুট চেকের পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। ওই ফ্লাইটে তাকে পাইলটের আসনে বসিয়ে বলা হয়েছিল বিমান চালানোর জন্য। কিন্তু ফারিয়াল কোন কমান্ডই সঠিকভাবে দিতে পারেননি। ফারিয়ালের সঙ্গে কি ধরনের রোষানল ছিল জানতে চাইলে এ তিনি বলেন, বিমানে ফ্লাইট ডাটা মনিটরিং করার জন্য ব্ল্যাকবক্স আছে।

ওই ব্ল্যাকবক্স পরীক্ষা করলেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। তার ওপর আমার কোন রোষানল ছিল না। ফেল করায় মুলত ফারিয়াল মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। দুই দফায় তাকে মানষিক ডাক্তারের কাছে পাঠানোর সুপারিশ করে করেছেন কেন জানতে চাইলে জোয়ারদার বলেণ, এটা ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত, বিমানের চীফ মেডিক্যাল অফিসার (সিএমও) জানেন। এনিয়ে আমি কোন সুপারিশ করিনি। দুই স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার নেপথ্যে কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা পারিবারিক ঘটনা। এর সঙ্গে বিমানের কোন সম্পর্ক নেই।
এ প্রসঙ্গে বিমানের সিএমও ডাক্তার তাসলিমা বলেন, কো পাইলট ফারিয়ালকে মানষিক ডাক্তারের কাছে পাঠানো বিমানের নিয়মিত কাজের একটি অংশ। নিয়ম অনুযায়ী কোন প্রার্থী প্রথম দফায় মেডিকেল পরীক্ষায় ফিট প্রমানিত হলে দ্বিতীয় দফায় মেডিক্যাল করাতে হলে পরিচালক (হেলথ) এর অনুমতি নিতে হয়। এই অনুমতি নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে সিএমও বলেন, আইন অনুযায়ীর যা যা করার দরকার সব করা হয়েছে।

যেভাবে ঘটনার সুত্রপাত
গত বছরের মে মাসে চট্টগ্রামে গ্রাউন্ড সার্ভিস ইকুইপমেন্ট (জিএসই) শাখার ভারি যন্ত্র পুশকার্ডের ধাক্কায় বিমানের একটি উড়োজাহাজের মূল দরজাটি ভেঙে যায়। ওই ফ্লাইটের পাইলট ক্যাপ্টেন ইসমত ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং বিভাগের কর্মীদের দায়িত্ব অবহেলা, অজ্ঞতা ও খামখেয়ালিপনাকে দায়ী করা হয়। ফ্লাইটে কো পাইলট হিসাবে ছিলেন ক্যপ্টেন ফারিয়াল। ওই ঘটনায় ক্যাপ্টেন ইসমতের পাশাপাশি ফারিয়ালকেও ৩ মাস গ্রাউন্টেড করে রাখা হয়। এনিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। পরবর্তীতে তদন্তে ফারিয়াল খালাস পান। দীর্ঘদিন গ্রাউন্ডেট থাকায় নিয়ম অনুযায়ী ফারিয়ালকে আবারো রুট চেক ট্রেনিং পরীক্ষা দিয়ে অপারেশন শুরু করার কথা। বিমানে এধরনের পরীক্ষায় এর আগে এ পর্যন্ত কেউ ফেল করেছে এমন নজির নেই। পাইলটদের অপারেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী ট্রেনিং পাইলট তার পছন্দের যে কোন ইন্সট্রাকটরের অধীনে এই রুট চেক পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পান।

বর্তমানে বিমানে ৫ জন ইন্সট্রাকটর পাইলট আছেন। সে অনুযায়ী ফারিয়াল বিমান ম্যানজেমেন্টকে জানান, ক্যাপ্টেন জোয়ারদার ছাড়া বাকী যে কোন ৪ জন ইন্সট্রাকটরের অধীনে তিনি রুট চেক পরীক্ষা দিতে আগ্রহী। কিন্তু অভিযোগ আছে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের একটি সিন্ডিকেট ফারিয়ালের এই আবেদন অগ্রাহ্য করে ইন্সট্রাকটর জোয়ারদারকেই তার ট্রেনিং পরীক্ষক নিয়োগ দেন। এদিকে পরীক্ষার আগে ক্যাপ্টেন জোয়ারদার জানতে পারেন ফারিয়াল তার অধীনে পরীক্ষা দিতে  রাজী নন। ধারনা করা হচ্ছে এতেই ক্ষুব্দ হন জোয়ারদার। যার কারণে রুট চেক শেষে ফারিয়াল জানতে পারেন তিনি ফেল করেছেন। এরপর ফারিয়াল বিমানের এমডি বরাবর জোয়ারদার সম্পর্কে বিভিন্ন অভিযোগ এনে ৮ পৃষ্ঠার একটি আবেদন দায়ের করেন।

এই ঘটনায় বিমানের ফ্লাইট অপারেশন, ট্রেনিং, সিডিউলিং বিভাগ ও বিমানের শীর্ষ ম্যানেজমেন্ট ফারিয়ালের উপর ক্ষুব্দ হন। তারা ফারিয়াল পাগল হয়ে গেছে উল্লেখ করে তাকে মানষিক ডাক্তারের ফিটনেস সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য বিমানের সিএমও ডাক্তার তাসলিমাকে নির্দেশ দেন। জানাগেছে সিএমও বিমানের নীতিমালা অনুযায়ী তাকে একজন ডাক্তারের কাছে পাঠান। ওই ডাক্তার ফারিয়ালকে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান।

এ প্রসঙ্গে জানতে ফাস্ট অফিসার ফারিয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। শুধু জানান, তার অভিযোগ বিমানের কাছে লিখিতভাবে দেয়া হয়েছে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.