চোরাচালানে ফ্লাইট কেনাবেচা

maxresdefaultশক্তিশালী চোরাচালান চক্র কিনে নেয় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ফ্লাইটগুলো কেনা হয় চড়ামূল্যে। চোরাচালান চক্রের কেনা পাইলট ও ক্রু দিয়েই চালানো হয় এই ফ্লাইটগুলো। আর এসব ফ্লাইটে করে আসে সোনা, ওষুধ ও বিদেশি মুদ্রার অবৈধ চালান। অনুসন্ধানে জানা যায়, চোরাচালানের পণ্য নির্বিঘ্নে পার করতে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিনে নেওয়া হয়। চোরাচালানের ভাগ যায় বিমানের সংশ্লিষ্ট শাখার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের কাছেও। চোরাচালান রুখতে একের পর এক বিমানের উড়োজাহাজ পর্যন্ত জব্দ করা হয়েছে। এমনকি বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেফতার করা হলেও কার্যত চোরাচালান বন্ধ করা যায়নি। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চোরাচালান চক্র এতটাই ভয়ঙ্কর, উড়োজাহাজের স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে পণ্য রাখার জন্য নিজেরাই বিশেষ স্থান তৈরি করে নেয়। ওই গোপন স্থানে করেই তারা সোনাসহ বিভিন্ন চোরাই পণ্য নিয়ে আসছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চোরাই সোনাবহনের অভিযোগে গত দুই বছরে বিমানের চারটি উড়োজাহাজ জব্দ করেছে শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া গত অক্টোবর পর্যন্ত ৪০ মাসে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর চোরাচালানের এক হাজার ৫৮ কেজি সোনা আটক করেছে। এসব সোনার মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এ সময় গ্রেফতার হন ১৩১ জন। এদের মধ্যে বিমানসহ বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার সদস্য এবং যাত্রী সাধারণ রয়েছেন। বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক আহম্মেদ  জানান, বিভিন্ন এয়ারলাইন্স ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান করছে, এটা ঠিক। বিমানের কয়েকটি ফ্লাইট থেকে চোরাই পণ্য উদ্ধার হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত থাকায় কতিপয় ক্রুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চার্জশিটও হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন আছে। তিনি বলেন, যারাই এসব চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাবে বিমান। তবে ফ্লাইট কেনার কথা তিনি স্বীকার না করে বলেন, এটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তদন্তে প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান  বলেন, ইতিপূর্বে সোনা আটকের ঘটনার তদন্তে বিমান কর্মকর্তাদের নাম বেরিয়ে আসে। দেশের সবচেয়ে বড় চালান ১২৪ কেজি সোনা আটকের ঘটনায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। যাদের মধ্যে ১০ জন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কর্মী। তাদের সহযোগিতা ছাড়া সোনা চোরাচালান কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানান কাস্টমসের এই শীর্ষ কর্মকর্তা। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত একজন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) বলেন, এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় সোনা চোরাচালান ছিল শাহজালালে ১২৪ কেজি ও ১০৫ কেজি আর চট্টগ্রামের শাহ আমানতে ১০৬ কেজি। আর এই তিনটি চালানই উদ্ধার করা হয়েছে বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ থেকে। কাজেই বিমানের পাইলট, কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা ছাড়া তাদের উড়োজাহাজে সোনা চোরাচালান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এদের সঙ্গে জড়িত রয়েছে সিভিল এভিয়েশনেরও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। একটি গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একের পর এক সোনা চোরাচালানির ঘটনায় বিমানের ৭৭ কর্মকর্তার নাম তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে সংস্থাটির ১০ জন পাইলট ও ৩০ জনেরও বেশি কেবিন ক্রুু রয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চোরাচালানিদের কাছে সবচেয়ে দামি রুট হচ্ছে দুবাই, জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম ও কুয়েত। এসব রুটে বিমানের নিজস্ব উড়োজাহাজ যাতায়াত করে। বিমানের শিডিউলিং, অপারেশন ও ট্রেনিং শাখার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা চোরাচালান চক্রের কাছে ফ্লাইট বিক্রির সঙ্গে জড়িত। প্রতি ফ্লাইটের জন্য এরা নিচ্ছে ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা। এই হিসাবে সপ্তাহে পাঁচ কোটি টাকার বেশি অর্থ ফ্লাইট কেনার নামে লেনদেন হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ফ্লাইটে চোরাচালান চক্রের আগাম কেনা পাইলট ও কেবিন ক্রুদের ডিউটি দেওয়া হয়। এদের মধ্যে কেবিন ক্রুরা মূলত চোরাই পণ্যের বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকেন। এসব কেবিন ক্রুর অধিকাংশই বিমানে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ফ্লাইট কেনার বিষয়টি বায়বীয়। এটা দেখা যায় না। মূলত বিক্রি হয় ক্রু। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগামী নির্দিষ্ট ফ্লাইটে মোটা অর্থের বিনিময়ে ওইসব ক্রুর ডিউটি দেওয়া হয়। শাহজালালে ক্রুদের ব্যাগ সেভাবে তল্লাশি না করায় তারা নিরাপদে চোরাচালানের কাজ করতে পারছেন। ফ্লাইট শিডিউল বিভাগের এক কর্মী জানান, ফ্লাইট ক্রুর সহায়তা ছাড়া ওই এয়ারক্রাফটে কোনোভাবেই চোরাই পণ্য তোলা সম্ভব নয়। অভিযোগ রয়েছে, বিমানের ফ্লাইট কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন পলাশ নামে এক ব্যক্তি। তিনি বিমানের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তার নাম ভাঙিয়ে চোরাচালানের কাজ করতেন। সেই পলাশের দেখানো পথ ধরেই চলছে একই প্রক্রিয়ায় চোরাচালান।

সূত্রঃবাংলাদেশ প্রতিদি্ন

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.