৬ এমডির মেয়াদে খেলাপি বৃদ্ধি ২০ হাজার কোটি টাকা

base_1477250025-untitled২০১০ সাল থেকে মূলত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে দ্রুত হারে। এ সময় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকের ছয় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) মেয়াদেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এ ছয় এমডি হলেন— সোনালী ব্যাংকের মো. হুমায়ুন কবির, অগ্রণী ব্যাংকের সৈয়দ আবদুল হামিদ, রূপালী ব্যাংকের এম ফরিদ উদ্দিন, বেসিক ব্যাংকের কাজী ফখরুল ইসলাম, জনতা ব্যাংকের আবদুস সালাম ও কৃষি ব্যাংকের মো. মোখতার হোসেন। এর মধ্যে আবদুস সালাম এখনো জনতা ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ ছয় এমডি দায়িত্ব গ্রহণের সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। বিভিন্ন মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে তারা বিদায় নেয়ার সময় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। অর্থাত্ ছয় এমডির মেয়াদে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে ২০ হাজার ২১৬ কোটি টাকা। আর বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩৪ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যার প্রায় ৬০ শতাংশই সৃষ্টি হয়েছে এ ছয় এমডির মেয়াদকালে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা  বলেন, যেসব বড় ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল, সেগুলোর বড় অংশ আবারো খেলাপি হয়ে যাওয়ার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে গিয়ে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। কারণ নতুন নিয়মে ঋণ পরিশোধের সময় কমিয়ে আনা হয়েছে।

ছয় এমডির মেয়াদে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, পরিসংখ্যান না দেখে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা কঠিন।

সোনালী ব্যাংক: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংকের আর্থিক বিপর্যয় শুরু হয় ২০১০ সালে। ওই বছরের ২০ মে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে যোগ দেন মো. হুমায়ুন কবির। যোগদানের সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। ২০১২ সালের ১৯ মে দায়িত্ব ছাড়ার সময় মাত্র দুই বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। অর্থাত্ তার সময়ে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা বা ৮৪ শতাংশ।

ব্যাংকিং খাতে আলোচিত হল-মার্ক কেলেঙ্কারি সংঘটিত হয় তার সময়েই। অনিয়মের মাধ্যমে শুধু হল-মার্ক গ্রুপই ব্যাংকটি থেকে হাতিয়ে নেয় আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি।

হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংকটির টালমাটাল অবস্থায় ২০১২ সালের ১৭ জুন এমডি পদে যোগ দেন প্রদীপ কুমার দত্ত। এর পর পর ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৯ হাজার ৩২২ কোটি টাকায় নেমে এলেও অস্বাভাবিক বাড়ে ঋণ অবলোপনের পরিমাণ। ২০১২ সালে সোনালী ব্যাংকের ঋণ অবলোপন ছিল ১ হাজার ১৯ কোটি টাকা। প্রদীপ কুমার দত্ত দায়িত্ব ছাড়ার সময় ব্যাংকটির অবলোপনকৃত ঋণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা।

রূপালী ব্যাংক: এম ফরিদ উদ্দিন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন ২০১০ সালের ১৮ মার্চ। যোগদানের সময় শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৬ জুন তিনি বিদায় নেয়ার সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকায়। এম ফরিদ উদ্দিনের দায়িত্ব পালনকালে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা বা ৯৭ শতাংশ।

তিন দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি করায় ব্যাংকটিতে প্রায় ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন এম ফরিদ উদ্দিন। তার মেয়াদকালে ব্যাংকটির কলেবর বৃদ্ধি পেলেও বিপর্যয় হয়েছে প্রায় সব সূচকে। কমেছে নিট আয়, বেড়েছে লোকসানি শাখার সংখ্যা।

অগ্রণী ব্যাংক: ২০১০ সালের ১৩ এপ্রিল রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে যোগ দেন সৈয়দ আবদুল হামিদ। এমডি পদে সৈয়দ আবদুল হামিদের যোগদানের সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ১০২ কোটি টাকা। ব্যাংকটির প্রায় ৭৯২ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে চলতি বছরের ২৯ জুন অপসারিত হন সৈয়দ আবদুল হামিদ। অপসারণের সময় ব্যাংকটিতে তিনি খেলাপি ঋণ রেখে যান ৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। অর্থাত্ তার সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৮৯০ কোটি টাকা বা ১৩৭ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির অবলোপনকৃত ঋণ ছাড়িয়েছে ৫ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা।

বেসিক ব্যাংক: প্রতিষ্ঠার পর থেকে লাভজনক ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃত ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের। ২০১১ সালের ৯ জুন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন কাজী ফখরুল ইসলাম। সে সময় বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ২৬০ কোটি টাকা, যা ছিল ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ৫ দশমিক ১০ শতাংশ। একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়ে ২০১৪ সালের ২৫ মে অপসারিত হন কাজী ফখরুল ইসলাম। দায়িত্ব পালনের তিন বছরে তিনি ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ রেখে যান ৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৫৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। তার মেয়াদে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৪৯ কোটি টাকা বা ২ হাজার ৩২৬ শতাংশ।

বেসিক ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মাজিদ বলেন, কমিশনের বিনিময়ে ঋণ বিতরণ করলে সে ঋণ তো খেলাপি হবেই। ২০১০ সালের পর থেকে ব্যাংকটিতে যা হয়েছে, তাকে চুরি-ডাকাতি বলা যায়, কোনোভাবেই ব্যাংকিং বলা যায় না। ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো করার জন্য বর্তমান পর্ষদ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক: কৃষি খাতে ঋণ বিতরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে ২০০৮ সালের ২৮ জানুয়ারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন মো. মোখতার হোসেন। তার যোগদানের সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। ২০১২ সালের ৪ জুলাই দায়িত্ব ছাড়ার সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। মো. মোখতার হোসেন চার বছর দায়িত্ব পালনকালে কৃষি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বা ১০১ শতাংশ।

মো. মোখতার হোসেনের সময়ে ব্যাংকটি কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ থেকে সরে এসে ব্যাপক মাত্রায় বাণিজ্যিক খাতের আমদানি ও রফতানিতে বড় অংকের ঋণ বিতরণ শুরু করে। তার মেয়াদে বিতরণকৃত অধিকাংশ ঋণই পরবর্তীতে খেলাপি হয়ে যায়। বর্তমানে বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছে কৃষি ব্যাংক।

জনতা ব্যাংক: রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর যোগদান করেন আবদুস সালাম। তার যোগদানের সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। ব্যাংকটিতে তিনি যোগদানের পর প্রায় দুই বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৯১ কোটি টাকায়। এ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মেয়াদে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা বা প্রায় ৫০ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকটির ঋণ অবলোপন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির জন্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ ও পরিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দায়ী। কেউ অপরাধ করলে তার যথার্থ বিচার না হওয়ার কারণে অপরাধীরা উত্সাহিত হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো তাদের খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.