রিজার্ভ চুরি: সাবেক অর্থমন্ত্রীর অবহেলায় প্রকাশ পায়নি প্রতিবেদন

রিজার্ভ চুরি: সাবেক অর্থমন্ত্রীর অবহেলায় প্রকাশ পায়নি প্রতিবেদন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার প্রতিশ্র“তি দিলেও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করেননি।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু একটি রিপোর্টও প্রকাশ করা হয়নি। সবার দাবি উপেক্ষা করে প্রতিবেদনগুলো ফাইলবন্দি করে রাখা হয়েছে।
বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অবহেলার কারণে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পায়নি।
প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশিত না হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়ক সংসদীয় কমিটিও তদন্ত প্রতিবেদন দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের দেখানো হয়নি।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তিনি প্রতিবেদন প্রকাশের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের দাবি জানিয়েছিল।
পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মহল ও অর্থনীতিবিদরাও এ প্রতিবেদন প্রকাশের পক্ষে জোরালো মতামত দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোটাই আমলে নেননি সাবেক অর্থমন্ত্রী। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার জন্য একাধিকবার ঘোষণা দিয়েও তিনি তা প্রকাশ করেননি।
এদিকে বৃহস্পতিবার ফিলিপাইনের আদালত বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির দায়ে অভিযুক্ত ম্যানিলাভিত্তিক রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক কর্মকর্তাকে সাজা দিয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সে সময় বলেছিলেন, তদন্ত রিপোর্টের ভেতর কী আছে তা জানি না। তবে অর্থমন্ত্রী নিজে বলেছেন, এই রিপোর্ট প্রকাশ করবেন। আমি মনে করি তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা উচিত ছিল।
তিনি আরও বলেন, তবে যে কোনো তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা এবং না করা এটি পুরোপুরি সরকারের এখতিয়ার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, আমি জানি সাবেক অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন ছিল, তিনি তা প্রকাশ করেননি। প্রতিবেদনে সত্য-মিথ্যা কি ছিল সে সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতে পারিনি।
আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত প্রতিবেদন : রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে কমিটি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কীভাবে, কার বরাবরে ভুয়া পেমেন্ট ইন্সট্রাকশন পাঠানো হয়েছিল, অবৈধ পরিশোধ ঠেকাতে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল কিনা, রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রায় এক মাস গোপন রাখা যৌক্তিক ছিল কিনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের অবহেলা ছিল কিনা এবং অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা, গৃহীত কার্যক্রমের পর্যাপ্ততা ও পুনরাবৃত্তি রোধে গৃহীত ব্যবস্থা খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ফরাসউদ্দিন কমিটিকে।
২০১৬ সালের ৩০ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেন ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। সে বছর ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বেক এই গভণর্নরকে প্রধান করে সরকার তিন সদস্যের কমিটি করে। কমিটি প্রথম ৩০ দিনের একটি অন্তর্বর্তীকালীন এবং ৭৫ দিনের মাথায় পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দেয়।
সেই রিপোর্ট প্রকাশের জন্য একাধিকবার ঘোষণা দিয়েও সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তা প্রকাশ করেননি। তদন্তের স্বার্থে ওই প্রতিবেদনটি ফিলিপাইনও বাংলাদেশ সরকারের কাছে চাচ্ছে। কিন্তু আইনগত কারণে সেটি তাদেরকেও দেয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঘটনা জানার জন্য নিজেরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। সে তদন্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি। ওই প্রতিবেদনের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভকে নিরাপদ রাখতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু গাফিলতির দায়ে কোনো কর্মকর্তার শাস্তি হয়নি।
এ বিষয়ে মূল তদন্ত করছে সিআইডি। তারা নিবিড়ভাবে তদন্ত করলেও এখনও তাদের কাজ শেষ হয়নি। সিআইডি বলেছে, তদন্ত কাজে তারা বিভিন্ন সংস্থার কাছে তথ্য চেয়েছে। ওই সব তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি। যে কারণে তাদের তদন্ত শেষ হয়নি।
গত ৪ জানুয়ারি এ বিষয়ে সিআইডি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করার কথা ছিল। ওই দিন তারা আদালতকে জানিয়েছে তাদের তদন্ত কাজ শেষ হয়নি। যে কারণে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারছে না। এজন্য আরও সময় চেয়েছে।
এ ঘটনা তদন্ত করতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই থেকেও একটি কমিটি হয়েছিল। তারাও তদন্ত করেছে। তবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।
শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে আলাদা তদন্ত করেছে। তবে কোনো প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখেনি।
আলোর মুখ দেখছে না কমিটির সুপারিশগুলো : তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না পাওয়ায় আলোর মুখ দেখছে না কমিটির সুপারিশগুলো। জানা গেছে, তদন্ত রিপোর্টে ফিলিপাইন থেকে অর্থ ফেরত আনতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক কৌশলে তৎপরতা ও যোগ্য আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এছাড়া কমিটির সুপারিশের মধ্যে সংস্কারের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংককে আনতে বলা হয়। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকরী, বাস্তবমুখী প্রযুক্তি ব্যবহার, দক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর এবং রেগুলেটরি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া সার্ভেইলেন্স ম্যাকানিজম সৃষ্টি ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির সুপারিশও করে কমিটি। পাশাপাশি জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীকে এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি দেয়া এবং প্রধানমন্ত্রীকে তদন্ত প্রতিবেদনের কপি সরবরাহের মতামত দিয়েছে কমিটি।
যেভাবে রিজার্ভের অর্থ চুরি হল : ২০১৬ সালের ৪ ফেব্র“য়ারি সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে ৩৫টি ভুয়া বার্তা পাঠিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (ফেড) রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে একটি মেসেজের মাধ্যমে শ্রীলংকায় ‘ভুয়া’ এনজিওর নামে ২ কোটি ডলার সরিয়ে নেয়া হলেও বানান ভুলের কারণে সন্দেহ হওয়ায় শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।
ওই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক দু’দিনের মধ্যেই ফেরত আনতে সক্ষম হয়। বাকি চারটি মেসেজের মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সরিয়ে নেয়া হয় ফিলিপিন্সের মাকাতি শহরে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের জুপিটার স্ট্রিট শাখায়। সেটি নিয়েই এখন আইনি প্রক্রিয়া চলছে।
ইতিমধ্যে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার দেশে ফেরত এসেছে। বাকি ৬ কোটি ৬৫ লাখ ডলার এখনও ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। সে সময় ওই শাখার ব্যবস্থাপক ছিলেন দিগুইতা। পরে সেই অর্থ ফিলিপিন্সের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিলরেমের মাধ্যমে দেশটির তিনটি ক্যাসিনোতে যায়। তারপর থেকে সেই অর্থের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
এর মধ্যে একটি ক্যাসিনোর মালিকের কাছ থেকে দেড় কোটি ডলার উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অর্থ উদ্ধারে এখনও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির দায়ে ম্যানিলার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দিগুইতার ৩২ থেকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ৯২৭ কোটি টাকা (১০ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার)।
বৃহস্পতিবার ফিলিপাইনের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। আদালত সাবেক এই ব্যাংক কর্মকর্তাকে মানি লন্ডারিংয়ের ৮টি অভিযোগের সবক’টিতে দোষী সাব্যস্ত করে এ সাজা দিয়েছেন।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.