জনবল কমাতে গিয়ে স্বেচ্ছায় অবসর বা গোল্ডেন হ্যান্ডশেক করে বেকায়দায় রয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওই পাওনা পরিশোধ করতে সরকারের কাছ থেকে ২৯০ কোটি ১০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। যা এখন সুদাসলে ৪১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। পরিশোধ করতে না পেরে ওই টাকা মওকুফের আবেদন করেছে সংস্থাটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিমানকে পুনর্গঠন ও বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ২০০৭ সালে কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর অংশ হিসেবে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ স্কিম বা ভিআরএসের আওতায় জনবল কমানো হয়। প্রায় অর্ধেক লোকবল কমিয়ে ৬৮৮৩ জন থেকে ৩৪০০ জনে আনা হয়। পেনশন/গ্রাচুইটিসহ অবসরপ্রাপ্তদের পূর্ণাঙ্গ সুবিধা দেওয়া হয় সেই সময়। এই গোল্ডেন হ্যান্ডশেক পরিশোধ বাবদ সরকারের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা এখন পরিশোধ করতে পারছে না বিমান। এ জন্য ঋণের ৪১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা মওকুফের জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএম মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে এই টাকা সরকারি ইকুইটি খাতে স্থানান্তর করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের ১ জুলাই থেকে ভিআরএসের আওতায় অবসর নেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তবে পুনর্নির্ধারিত (৩৪০০) জনবল দিয়ে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। ফলে পরদিন থেকেই এদের একটা বড় অংশকে নিয়োগ দিতে থাকে বিমান কর্তৃপক্ষ। তা ছাড়া ভিআরএসকে ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে অনেকে আদালতে মামলা করেন। এর আলোকে এখনো চলছে তাদের পুনর্বহাল। এখাতে সরকারের দেওয়া ঋণ ২৯০ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং সুদ বাবদ ১২৮ কোটি ৫২ লাখসহ ৪১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা পরিশোধ সম্ভব নয় বলে সম্প্রতি এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
বিমানসূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমান করপোরেশনকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের অনুমোদনসহ তাদের পাওনা পরিশোধে ২০০৭ সালে দুবার ঋণ হিসেবে টাকা দেয় সরকার। ওই বছরের ১৭ জুলাই এবং ১৫ নভেম্বর দুই কিস্তিতে মোট ২৯০ কোটি টাকা বার্ষিক ৫ শতাংশ সুদে সরকারি ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়।
সূত্রমতে, ঋণ পরিশোধে অপারগতার যুক্তি হিসেবে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছেÑ বিমানকে পুনর্গঠন ও বাণিজ্যিকীকরণের উদ্দেশ্যে নতুন প্রজন্মের বোয়িং কেনার সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এবং ২টি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ বিমানবহরে যুক্ত হয়েছে। এই ৬টি উড়োজাহাজ কেনা বাবদ বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি ব্যাংক থেকে ৮ হাজার ২৯৬ কোটি ৩ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে বিমান। ওই ঋণের কিস্তি বাবদ গত ৩০ জুন (২০১৬) পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৫১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা পরিশোধের পর গৃহীত ঋণের কিস্তি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৭৪৪ কোটি ৬ লাখ টাকা। আরও ৪টি বোয়িং ৭৮৭ উড়োজাহাজ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বিমানবহরে যুক্ত হবে। এতে ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে।
বর্তমানে প্রতিবছর গড়ে ৬০০ কোটি টাকা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া ভাড়া করা উড়োজাহাজের নিয়মিত ভাড়া পরিশোধের ফলে বিমানের নগদ তহবিল প্রবাহের ভারসাম্য রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এই বাস্তবতায় ভিআরএস বাবদ সরকারের ঋণ ও ঋণের ওপর পুঞ্জীভূত সুদসহ মোট ৪১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা সরকারি ইকুইটি খাতে স্থানান্তর করতে অনুরোধ করা হয় বিমানের পক্ষ থেকে।
তবে বিমানের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ভিআরএসের ঋণের টাকা নিয়ে তখন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। অলিখিতভাবে সে সময় বলা ছিলÑ এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। তাই এবার লিখিতভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদিও তাতে উল্লেখ আছে আর্থিক সমস্যার কথা।
এদিকে বাংলাদেশ বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি (পিএলসি) করার পর ২০০৮ সালে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) বিল মওকুফ করা হয়। সেই সময় এর পরিমাণ ছিল ৫৭৩ কোটি ৭০ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৯ টাকা। এবার ভিআরএস বাবদ ঋণের ৪১৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা মওকুফের দাবি করছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
বিমানের প্রশাসন বিভাগ জানিয়েছে, জনবল কাঠামো পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্তের পর ৫ বছর বা তদূর্ধ্বকাল ধরে কর্মরতদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হয় ওই সময়ে। স্বেচ্ছায় অবসরপ্রাপ্তদের পূর্ণ সুবিধা ছাড়াও দেওয়া হয় অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা। চাকরির মেয়াদকাল ন্যূনতম ২৫ হলে ১৫ শতাংশ, ২০ থেকে ২৫ বছরের নিচে হলে ২০ শতাংশ, ১৫ থেকে ২০ বছরের নিচে হলে ২৫ শতাংশ এবং ৫ থেকে ১৫ বছরের নিচে হলে ৩০ শতাংশ হারে প্রাপ্য গ্রাচুইটি বা পেনশনের ওপর সুবিধা দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ স্কিমের আওতায় ১৮৭৭ জনকে ৩০৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয় তখন। এর পর বিষয়টি মামলায় গড়ালে তাতেও খরচ হয় ও পরবর্তীকালে ভিআরএসপ্রাপ্ত লোকদের নিয়োগ দিতে হয় এবং হচ্ছে। পাশাপাশি ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে তখন থেকেই অতিরিক্ত লোক দিয়ে বিমানকে চালিয়ে নিতে হয়। বর্তমানে সংস্থাটির জনবল পাঁচ হাজারের বেশি। এ জন্য গুনতে হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। যদিও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিমান নিট মুনাফা অর্জন করেছে ২৭৬ কোটি টাকা। অবশ্য এর আগের অর্থবছরে (২০১৪-১৫) মুনাফার পরিমাণ ছিল ৩২৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আয় কমেছে ৪৮ কোটি টাকা। তবে এ ব্যাপারে বিমানের দাবি, গত বছরের ৮ মার্চ থেকে যুক্তরাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা জারির কারণে কার্গো পরিবহন তুলনামূলক কম হয়েছে। এ কারণে আয়ও কিছুটা কম হয়েছে।
সূত্র:আমাদের সময়