অনভিজ্ঞ পাইলট দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট!

অনভিজ্ঞ পাইলট দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট!

পাসপোর্ট-রহস্য কাটতে-না-কাটতে বাংলাদেশ বিমানের বিরুদ্ধে অনভিজ্ঞ একজন পাইলটকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফ্লাইট পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। ল্যান্ডিং পারমিশন নেই এমন কো-পাইলটকে দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ৮ জুন কাতার থেকে ফেরার সময় প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যে ফ্লাইটের পাসপোর্ট-কাণ্ড ঘটেছে ওই ফ্লাইটের কো-পাইলট ক্যাপ্টেন সাদতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ। এয়ার সংস্থাটির অপারেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী ২৫০ ঘণ্টা ফ্লাইট পরিচালনার আগে কোনো কো-পাইলট ল্যান্ডিং করতে পারেন না। কিন্তু বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারে ওই ফ্লাইটের কো-পাইলট ক্যাপ্টেন সাদতের ফ্লাইং আওয়ার ছিল মাত্র ১৮২ ঘণ্টা।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের একটি ভিভিআইপি ফ্লাইটের বৈমানিক বাছাই করা নিয়ে বিমানের এ আচরণ কোনোভাবে ক্ষমার যোগ্য নয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এ ধরনের কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও আনাড়ি বৈমানিক দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট পরিচালনার সিদ্ধান্ত বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।
তার মতে, ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদের পাসপোর্ট ফেলে যাওয়া হয়তো ভুল হতে পারে, কিন্তু তিনি জেনেশুনে কীভাবে একজন অনভিজ্ঞ বৈমানিককে কো- পাইলট হিসেবে বাছাই করলেন? এ ক্ষেত্রে মূল দায়ভার নিতে হবে বিমানের পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন ডিএফওকে। কারণ বিমানে ভিভিআইপি ফ্লাইটের পাইলট-ক্রু বাছাই করার দায়িত্ব ডিএফও ও চিফ অব ট্রেনিংয়ের আওতাধীন।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিষয়টি তারা শুনেছেন। ইতিমধ্যে তারা বিমানের কাছ থেকে এ বিষয়ে তথ্য জানতে চেয়েছেন। প্রাথমিক তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন ক্যাপ্টেন সাদতের ফ্লাইং আওয়ার কম ছিল। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তার আওয়ার কত ছিল এটা জানতে পারেননি।
এটা জানার পর রেগুলেটরি কমিশনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ কোনো অনভিজ্ঞ পাইলটকে ভিভিআইপি ফ্লাইটে পাঠানো ঠিক হয়নি।
বিমানের সাবেক একজন পাইলটও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২৫০ ঘণ্টার যে অভিজ্ঞতার কথা অপারেশন ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে সেটি মূলত বিমানের সাধারণ ফ্লাইটের ক্ষেত্রে। ভিভিআইপি ফ্লাইটের ক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতা অলিখিতভাবে আরও অনেক বেশি। আগে কখনও ৫০০ ঘণ্টার কম অভিজ্ঞ পাইলটকে ভিভিআইপি ফ্লাইটে দেয়া হতো না।
তার মতে, যদি কোনো কারণে ওই দিনের ভিভিআইপি ফ্লাইটে ক্যাপ্টেন সাদতকে দিয়ে অবতরণের প্রয়োজন হতো তাহলে সেটি হতো বড় ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ। একই সঙ্গে তা হতো বিমানের অপারেশন ম্যানুয়াল পরিপন্থী।
আসলে ভিভিআইপি ফ্লাইট নিয়ে বিমানে এসব কি হচ্ছে? একই ফ্লাইটে মূল পাইলট ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ ইমিগ্রেশনকে ফাঁকি দিয়ে পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশ চলে গেলেন। অথচ বিমানের অপারেশন ম্যানুয়ালের জেনারেল ধারার ৫.২৬.২(১)-এ বলা হয়েছে- ভিভিআইপি ফ্লাইটের ক্রুদের ক্ষেত্রে ভ্যালিড ট্রাভেল ডকুমেন্ট সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক। আর ট্রাভেল ডকুমেন্ট হচ্ছে পাসপোর্ট। ওই পাইলট আরও বলেন, ‘ভিভিআইপি ফ্লাইটে সাধারণত থার্ড পাইলট দেয়া হয়। কিন্তু ককপিটে থার্ড পাইলটের ভূমিকা কম। বিমান পরিচালনা উড্ডয়ন-অবতরণসহ সব কাজে মূল ভূমিকায় থাকেন ককপিটের বাম চেয়ারে থাকা পাইলট আর ডান চেয়ারে থাকা কো-পাইলট। থার্ড পাইলট তাদের পেছনে একটি চেয়ারে বসে থাকেন।
ফ্লাইট যখন আকাশে থাকে তখন মূল পাইলটের কোনো ধরনের অসুবিধা, জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া, হার্ট ফেইলিওর, স্ট্রোকজনিত কারণ হলে থার্ড পাইলট দ্রুত ফ্লাইট পরিচালনার দায়িত্ব নিতে পারেন। কিন্তু যখন ফ্লাইট ল্যান্ডিং পজিশনে থাকে কিংবা ৩ হাজার ফুট নিচে নেমে আসে সে সময় যদি কোনো পাইলট অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন একমাত্র কো-পাইলট ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে যদি কো-পাইলট ২৫০ ঘণ্টার বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হয়ে থাকেন তাহলে তিনি ফ্লাইটটি আয়ত্তে নিয়ে স্বাভাবিক ল্যান্ডিং করতে পারবেন।
এসব কারণ বিবেচনা করে ভিভিআইপি ফ্লাইটের সব পাইলটকে অপারেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হয়।
জানা গেছে, ক্যাপ্টেন সাদত ছিলেন বোয়িং ৭৩৭ মডেলের উড়োজাহাজের কো-পাইলট। তিনি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারে রুট চেক করেছেন চলতি বছরের ২৫ মার্চ। পরের মাসের ৬ তারিখ তিনি ওই বিমানে প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করেন। আর মাত্র ২ মাসের মাথায় রহস্যজনকভাবে বিমান তাকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট পরিচালনার জন্য কো-পাইলট হিসেবে নির্বাচিত করে।
অথচ বিমানে এই উড়োজাহাজে ২৫০ থেকে ৬০০ ঘণ্টা ফ্লাই করেছেন এমন অভিজ্ঞ ও দক্ষ কো-পাইলট রয়েছেন কমপক্ষে ৫ থেকে ১০ জন।
অভিযোগ আছে- কো-পাইলট সাদতের অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি বিমান পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) কার্যকরী কমিটির একজন প্রভাবশালী সদস্য এবং বাপার সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবের ঘনিষ্ঠজন।
এ কারণে বিমানের সিডিউলিং বিভাগ কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ক্যাপ্টেন সাদতকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটে কো-পাইলট হিসেবে পাঠায়।
এ প্রসঙ্গে বিমানের চিফ অব সিডিউলার ক্যাপ্টেন মানজুর রহমান বলেন, বিমানের এমডি ক্যাপ্টেন জামিল আহম্মেদের পারমিশন ছাড়া তিনি এ বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের তথ্য দিতে পারবেন না। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিমানের মুখপাত্র ও জেনারেল ম্যানেজার শাকিল মেরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। শাকিল মেরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘পাইলটদের নিয়ে কোনো তথ্য দেয়া নিষেধ আছে। ফ্লাইং আওয়ার একজন পাইলটের নিজস্ব বিষয়। এটি নিয়ে কোনো তথ্য দিতে পারব না।
এ বিষয়ে জানতে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন জামিল আহম্মেদকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। মঙ্গলবার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব মহিবুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এ বিষয়ে জানার জন্য ফার্স্ট অফিসার ক্যাপ্টেন সাদতের বাংলালিংক নম্বরে ফোন করলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানের নম্বরেও ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনিও ফোন রিসিভ করেননি। তিনি দেশের বাইরে আছেন বলে জানা গেছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, বারবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইট নিয়ে বিমানের এ ধরনের আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের একাধিক ফ্লাইট নিয়ে নানা বিপত্তি ঘটেছে; যা নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও স্পর্শকাতর।

সূত্রঃ যুগান্তর

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.